অমরেশ দত্ত জয়ঃ প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নানান আশ্বাসের মধ্যেও চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে এখনো সাম্প্রদায়িক হামলায় মন্দির ভাঙ্গচুরের ভয়াল সেই ঘটনা স্মরণ করে এক প্রকারের আতঙ্ক নিয়ে ২৮টি পূজো মন্ডপে দূর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যদিও প্রশাসন বলছে, পূজোর শুরুর দিন হতে শেষ হওয়ার দিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে প্রতিটি পূজো মন্ডপ।
১৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী হাজীগঞ্জের বিভিন্ন পূজো মন্ডপ এলাকা ঘুরলে সনাতনী নেতৃবৃন্দ ও মন্ডপ কমিটির নেতারা এই আতঙ্কের কথা কালবেলার এই প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন।
জানা যায়, কুমিল্লায় দূর্গো পূজোর মন্ডপে গেলো ২০২১ সালে কুরআন অবমাননার ধর্মীয় গুজব সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। যা নিয়ে কোন যাচাই বাছাই না করেই তৌহিদী জনতার ব্যাণারে কতিপয় দুষ্কৃতিকারী ধর্মীয় সুরসুরী দিয়ে হাজীগঞ্জে মিছিল করে এখানকার দূর্গা পূজোর বেশ কয়েকটি মন্ডপে অহেতুক হামলা, ভাঙ্গচুর ও লুটপাট চালায়। যেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে এসে হামলার স্বীকার হয় পুলিশ ও পৌর মেয়র মাহবুবসহ অনেকেই। যদিও পরবর্তীতে পুলিশের ওপর হামলা ও মন্দিরগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ঘটনায় মোট ১০টি মামলায় ৫ শতাধিক লোককে আসামী করা হয়। যেখানে প্রায় ২শ’ লোককে আটক করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হলেও তারা সবাই এখন জামিনে বাহিরে রয়েছেন।
হাজীগঞ্জ উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রাণ কৃষ্ণ সাহা বলেন, আমাদের সোনাইমুড়ীর সূত্রধর বাড়ী ও রামপুরের সনাতনীরা এখনো সেই সাম্প্রদায়িক হামলার বিভৎসতা ভুলতে পারছেনা। যদিও প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা দূর্গোৎসবে আমাদের পাশে থাকার সর্বোচ্চ আশ্বাস দিচ্ছেন। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য মডেল হিসেবে এবারের দূর্গোৎসবের মধ্য দিয়ে হাজীগঞ্জের সেই বিভৎসতা কাটিয়ে উঠাতে চাই।
হাজীগঞ্জ পৌর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল সাহা বলেন, সেদিন দুষ্কৃতিকারীরা রান্ধুনী মূড়া থেকে হাজীগঞ্জ বাজার পর্যন্ত মিছিল করে উল্টোপথে ফেরার সময় লক্ষী নারায়ন জিউর আখড়ায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে।মুহুর্তেই ওই মিছিলের দুষ্কৃতিকারীরা সাধারণ মুসলিমদেরও বিভ্রান্ত করে ২/৩ হাজার মুসলিমকে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তারা মন্ডপে মন্ডপে উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে তান্ডপ শুরু করে। এতে ত্রী নয়নী সংঘ, নবদূর্গা, রামকৃষ্ণ মিশন, দশভূজা, ত্রিশূল সংঘ, জমিদার বাড়ীসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি মন্ডপেই ধ্বংসলীলা শুরু হয়। যদিও পরবর্তীতে গেলো বছরের পাশাপাশি এবছরও সাংসদ মেজর রফিক, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে আমরা সমন্বয় রেখে দূর্গোৎসব করার প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা চাই আর কখনো যেনো কোন গুজব, উসকানি কিংবা ধর্মীয় সুরসুরী এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্থান হাজীগঞ্জবাসীকে স্পর্শ করতে না পারে।
২০২১ এর দূর্গোৎসবের ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সত্য ব্রত ভদ্র মিঠুন বলেন, অতীতের সাম্প্রদায়িক হামলার ভয়াবহতায় এখনো আমাদের হাজীগঞ্জের সনাতনী মা বোনসহ সবাই আতঙ্কে রয়েছেন। ঐ সময় স্কুল শিক্ষক মানিক রায় ঘটনা টি দেখে ষ্ট্রোক করে ঘটনা স্থলেই মারা যায়। হট্টগোলের সময় আরও ৪ জন নিহত হয়। এবার আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দূর্গা পূজো হচ্ছে। যদিও প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে আমরা সার্বক্ষণিক সমন্বয় রেখে সুন্দরভাবে দূগোৎসব করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। আমরা চাই অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তি যেনো আর কখনো বর্বোরচিত জঘন্যতম হামলা সনাতনীদের দূর্গোৎসবে চালাতে না পরে। সুন্দরভাবে শারদীয় দূর্গোৎসব সমাপ্ত করতে ঐক্য পরিষদ সকলের সহযোগিতা কামনা করছে।
২০২১ সালের পূজো মন্ডপে হামলার ঘটনার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হাজীগঞ্জ থানার ইন্সপেক্টর( তদন্ত) নজরুল ইসলাম বলেন, ঐ সময় চাঁদপুরের মধ্যে শুধুমাত্র হাজীগঞ্জেই মন্দির ভাঙ্গচুর ও হামলা হয়েছিলো। যার প্রেক্ষিতে সব মিলিয়ে ১০ টি মামলা হয় এবং সবগুলোর চার্জশীট দিয়ে দেয়া হয়েছে।
নিরাপত্তার বিষয়ে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থানার ওসি মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ বলেন, আমরা এবার এখানকার পূজো মন্ডপের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়নের ব্যবস্থা রেখেছি। প্রতিটি পূজো মন্ডপেই আমাদের একাধিক পুলিশ সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য ইউনিট সরব থাকবে। ৩টি বিশেষ মোড়কে টার্গেট করে আমাদের ট্রহল টিমসহ একাধিক ফোর্স কাজ করবে। আশা রাখছি অতীতের কোন সাম্প্রদায়িক ঘটনা হাজীগঞ্জে পুনরায় এবার আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ নেই। আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছি। অতএব সনাতন সম্প্রদায়কে আতঙ্কিত না থেকে নির্বিগ্নে তাদের দূর্গোৎসব করতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম ও জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান পৃথকভাবে বলেন, আমরা যেকোন মূল্যে উস্কানিদাতা ও ধর্মান্ধতাকে উৎখাত করতে কাজ করে যাচ্ছি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় ২০২১ এর চেয়েও ভয়াবহ পদক্ষেপ নিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। দেশেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে নিতে সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির থেকে রক্ষা করতে আমরা শারদীয় দূর্গোৎসবে হাজীগঞ্জসহ জেলার প্রতিটি পূজো মন্ডপকেই মনিটরিংয়ের আওতায় রেখেছি। সেই সাথে যেকোন অপতৎপরতা রোধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।