প্রিয় পারিজা,
জানি না আমার এই চিরকুটটা তোমার কাছে কবে পৌঁছাবে! জানি না চিরকুটটা হাতে পেলে তোমার শান্তদিপ্ত মনটা অশান্ত হয়ে যাবে কিনা! পড়বে তো মন দিয়ে?
নাকি হেলামির স্রোতে গা ভাসাবে? মুখটা ভেঙ্গচি কেটে আনমনেই বলতে থাকবে। এত্তদিন পর ভালোবাসা জেগেছে আমার জন্য! যেমনটা বলতে আমাকে সেই আগে, যখন তোমার মনের মাধুরীতে মিশেছিলাম একমাত্র এই “আমি”।
পারিজা, মনে পড়ে তোমার? সেই স্কুলের ছুটির ঘন্টার সময়ের কথাগুলো? তোমার আসার জন্য আমি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতাম।
তুমি স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে করে নীল ড্রেসটা পড়ে যখন বেরোতে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।মনে হতো এ যেনো আমার পারিজা নয় একটা সদ্য নীল পরী।
তোমাকে একটু খানি দেখার জন্য আমি আমার সব কাজ ফেলে চলে যেতাম। কিন্তু মন ভরে তোমাকে কখনোই দেখা হতো না। তুমি সবসময় একটা ছাতা মাথায় করে আসতে আর যেতে।
তোমাকে আমি আবছা আলোতে দেখেই তোমার প্রেমে পড়ে যাই। ঐ তো একটু খানি দেখা হতো গেইটের ওপার থেকে যখন আসতে। গেইটের বাহিরে এলেই ছাতাটা মাথায় দিয়ে দিতে। সুন্দরী রমনী হলে যা হয় আর কি।
তবুও ঐ একটুখানি দেখা আমার মনে উত্তাল ঢেউ খেলতো। হার্টবিট বেড়ে যেত তাই কখনো তোমার সামনে যাওয়া হয়ে ওঠে নি আমার। সাহস করে বলা হয়নি আমার মনের হাজারো কল্পনা তোমাকে ঘিরে।
তাছাড়াও আমাদের মধ্যে যে অনেক বড় একটা প্রাচীর ছিলো। যার জন্য কখনোই আমার মনের সাথে যুদ্ধ করা ঘটনাগুলো তোমাকে বলা হয় নি। শুধু নিজে প্রণেতাকে বলতাম। খুব অভিমান নিয়ে,” কেনো আমাদের পথ দুটো আলাদা করে দিলে প্রভু”?
ভালোবাসাকে প্রকাশ না করতে পারার যে কি নিদারুন যন্ত্রণা আমি তখন বুঝতে পারলাম পারিজা।
বছর দুই পর তোমার স্কুল শেষ, কলেজ গেলে। আমিও বেয়াহাপনা বড্ড। তোমার কলেজের কাছেই কোনো একটা আশপাশ ঘিরে কাজ খুঁজে নেই। তোমাকে কয়েকদিন ধরে না দেখতে পেয়ে খুব কষ্ট হচ্ছিল। মনপাখিটা যেনো বার বার বলতে লাগলো, নীলপরী টা কেমন আছো তুমি?
ভাবনায় ডুবতেই বিকেলের সূয্যিমামা টা গা ডুবতে নিলো। ঠিক তখনি আমার পাশ কেটে যাচ্ছিল একটা মেয়ে।
আমি যেনো কোথাও তখন একটা পরিচিত সুবাস পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য আমার হৃদয়ে কম্পন শুরু হলো। ধুকবুক করছে আমার হার্ট। পিছন ঘুরতেই দেখি চেনা পরিচিত সেই ছাতাটা। মনে মনে হাসিও পেলো এখনো সেই ছাতাটাই রাখলে নীলপরী!
বুকের ভেতরে একটা আশার আলো জ্বলে উঠলো। হয়তো আমার জন্যই এখনো ছাতাটা রেখেছো। তোমাকে চিনতে যেনো আমার কোনো সমস্যা না হয়।তোমার চেহারাটা না দেখলেও যেনো ছাতাটি দেখেও তোমাকে চিনতে পারি।
ভাবতে ভাবতেই তুমি খানিকটা পথ হেঁটে গেলে।তোমার পিছু নিলাম। বাসার খোঁজে কিন্তু তুমি সামনের মোড়েই আড়াল হয়ে গেলে। হতাশ হলেও মনে তখন অনেকটাই শান্তি আসলো। নিজেকে বলতে থাকলাম অবশেষে তার দেখা তো মিললো!
পরেরদিন ঠিক ঐ সময়টাতেই দাঁড়িয়ে আছি আমি সেই জায়গাতে। আজকে আর ভুল করবো না। নীলপরীকে দেখেই নেবো। সেই সাথে আলাপচারিতা! তুমিও ভুল করলে না তোমার আসতে একটু লেট হলেও তুমি আসলে সেদিন, বাসন্তী রংয়ের একটা চুড়িদার পড়ে। অসম্ভব সুন্দর লাগছিলো তোমাকে।
তোমার মায়াভরা মুখটা দেখার খুব বাসনা হলো। বিধির কি লীলা। সবেই মনটা চাইলো তোমাকে দেখতে আর কোথা হতে বাতাস এসে তোমার ছাতাটা উড়িয়ে দিলো।
তোমার উরন্ত কেশ এসে গোলাপি ঠোঁটে পড়লো, আর নয়নের পাঁপড়ির ভেতর হয়ে তোমাকে নিশ্চয়ই জ্বালা দিচ্ছিলো। বুঝলাম তোমার ভ্রু কুঁচকানো দেখে।
কেশগুলো সরাতেই আমাকে এক পলকে দেখে নিলে। আর তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ চলে গেলে। হয়তো এই এক পলকে তুমি ভেবেই নিয়েছো এই পাগল ছেলেটা আমার পিছু এখনো নেয়। হয়তো অবাক হয়েছো!
সেদিনের পর আর তোমাকে দেখা হয় নি। তবে সেই পলকপড়া রাস্তার মোড়ে বিকেলটা উপলব্ধি করা আমি উপলদ্ধি করি নি পারিজা। কেনো তোমাকে দেখার জন্য আমার মনটা বার বার ছুটে যেতো আমি তা জানতাম না নীলপরী।
বছর তিনেক পর শুনলাম তোমার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে। কথাটা শুনে আমার শরীরটা যেনো এক নিমিষেই রক্ত সঞ্চালন হারিয়ে ফেললো। শীতল হয়ে গেলো শরীরটা। কিন্তু জানি না কেনো। কালবৈশাখীর মতই ঝড়োমেঘ জমা হলো আমার মধ্যে। এক পলকেই ভাবতে থাকলাম, আমার নীলপরীটা আজ বধূ সাজে হয়তো ওদের রীতিমতো শাখাপলা, সিঁদুর ও দেয়। অন্য কারো জীবনসঙ্গী হয়ে গেলো আমার স্বপ্নের নীলপরীটা।
ওর কেশগুলো হয়তো এখন আর খোলা থাকে না। আর থাকলেও হয়তো সেটা খানিকটা সময়ের জন্য।আচ্ছা ওর এই খোলা কেশের ঘটনাটি কি এখনও আমাকে মনে করিয়ে দেয়? নাকি নিজেই বলতে থাকি বিড়বিড় করে।
অজান্তেই আমি হেসে উঠলাম একটা কথা ভেবে,”আচ্ছা নীলপরীটা কি এখনো ছাতা মাথায় করে বাহিরে বের হয়?”
লেখক পরিচিতি- কাকলী চক্রবর্তী।