অমরেশ দত্ত জয়ঃ আইনী তোয়াক্কা না করেই চাঁদপুরের নদীগুলোতে অসাধুরা অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে। যদিও প্রশাসন প্রায়ই অভিযান চালিয়ে কিছু কিছু অবৈধ ড্রেজারকে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হচ্ছে। তবুও যেনো কোনভাবেই এই অবৈধ ড্রেজারের বিশাল বহরের বালু উত্তোলন পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা বলে অভিযোগ রয়েছে।
২৮ জুলাই রোববার এক তথ্যে দেখা যায় গেলো ৩ মাসে নৌ পুলিশ ১৫টি অবৈধ ড্রেজার পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে নানা সময়ে আটক করেছে।
অনুসন্ধান বলছে, অবৈধ ড্রেজারের বালু উত্তোলনের কারনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনা নদী। এরমধ্যে এসব নদী এলাকায় বছর বছর নদী ভাঙ্গণ, ইলিশের আবাসস্থল তীলে তীলে ধ্বংস, বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদীতীরবর্তী এলাকা। বালু খেকোরা হাইকোর্টে রীট দেখিয়ে বিভিন্ন সময়ে অবৈধ ড্রেজারে শত শত কোটি টাকার বালু তুলে বিক্রি করে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করছে।চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের রাজস্ব বিভাগে আলোচনা করলে জানা যায়, চাঁদপুরে ৮টি বালু মহাল ছিলো। তবে এসব বালু মহাল ইজারার ওপর ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময় হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। আর এসব রীট ঘিরেই কতিপয় লোক নানা সময়ে শত শত ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করেছে। যার করনে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে বছরের পর বছর। যদিও চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশের হস্তক্ষেপে তথ্য উপাত্তে বেরিয়ে এসেছিলো, আদালতের রায়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ বালু তোলার অনুমতি থাকলেও বালু বিক্রির অনুমতি কখনোই ছিলোনা।
এক তথ্যে দেখা যায়, ড্রেজারে বালু কাটার জন্য চাঁদপুর সদরের ১৩০নং গুনানন্দী মৌজায় ৫৬৪ একর এবং হাইমচরে ১৭নং চরশোলাদী মৌজায় ৭৭১ একর নদীর জমিতে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে দেয়া হয়েছে। এ জরিপে বালু উত্তোলনের এলাকা চিহ্নিত করে উত্তোলনযোগ্য বালুর পরিমাণ নির্ণয়, নদীর পাড় হতে বালু উত্তোলনের স্থানের দূরত্ব, তফশিলসহ মৌজা ম্যাপ ও প্রতিবেদন করা হবে। এই কায়দায় মতলব উত্তরের কাউয়ার চর বরাদ্দের অপেক্ষায় আছে। এরমধ্যে মতলব উত্তরের রামগোপালপুর বালু মহাল টেন্ডার হয়েছিলো। পরে স্থানীয় দুগ্রুপের ঝামেলায় মামলা হওয়ায় পরে আর সেটি ইজারা হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ড্রেজারে বালু কাটার জন্য আমাদের হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের জন্য ১৫ লাখ ৫৭ হাজার টাকার যেই বরাদ্দটি পেয়েছি তা যথেষ্ট নয়। তাই নতুন করে চাহিদাপত্র পাঠিয়ে বরাদ্দপ্রাপ্ত হলে আমরা জরিপ কাজ শুরু করবো।
এদিকে চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএ এর ট্রাফিক ইনচার্জ বশির খান বলেন,নদীতে যে ড্রেজারগুলো চলছে তার কয়েকটির রেজিষ্ট্রেশন থাকলেও রুট পারমিট নেই একটিরও। কাজেই আমরা প্রায়ই তথ্য পেলে অবৈধ ড্রেজারের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি।
চাঁদপুরের বিআইডব্লিউটিএর বন্দর কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাহিদ হোসেন বলেন, বিআইডব্লিউটিএর হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের জরিপ ও নকশা ছাড়া কেউই বালু তুলতে পারেন না। কিন্তু দেখা গেছে, ‘হাইকোর্টের নির্দেশনা’ আছে—এমন দাবি করে কেউ কেউ মেঘনার বিভিন্ন স্থানে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে অবাধে বালু তুলছেন।
এদিকে বছরের পর চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনায় শত শত ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারনে ইলিশের আবাসস্থল ধ্বংসের মুখে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইলিশ গবেষকগণ। চাঁদপুরের সাবেক ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, ইলিশ এবং মাছের প্রতি দরদ থাকলে কখনোই অন্তত চাঁদপুরের পদ্মা মেঘনায় ড্রেজার বসানোর মতো কাজ হতোনা। ড্রেজারের বালু উত্তোলনের কারনে পানিতে থাকা মাছের খাবার, ডিম সব ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ইলিশের বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে এবং খাদ্য তন্ত্রে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ইলিশের জন্য চাঁদপুরের পদ্মা মেঘনার মতো এমন স্পর্শকাতর নদীতে আর ইলিশ পাওয়া যাবেনা।
অপর দিকে বছরের পর বছর ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলনের কারনে নদীতীরবর্তী এলাকাগুলো ভাঙ্গণের মুখে পতিত হয়েছে। চাঁদপুর সদরের রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক চোকদার বলেন, অবৈধ ড্রেজারের বালু উত্তোলনের কারনে রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের উত্তর পাশে মাল কান্দি, চোকদার কান্দি, ঢালী কান্দিসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারের বসতভিটা ভাঙন হুমকিতে রয়েছে। এছাড়া গত কয়েক বছরের ভাঙ্গনে একটি নবনির্মিত সাইক্লোনসেন্টার, কয়েকটি গণকবরস্থান, মসজিদ, ঈদগাঁ ও একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
সরজমিনে দেখা যায়, অবৈধ ড্রেজারের যত্রতত্র নদীতে বালু উত্তোলনে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধ এলাকা বিশেষ করে পুরানবাজারের হরিসভা ও এর আশপাশের এলাকা চরম হুমকিতে রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জহুরুল ইসলাম বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই ৮২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শহর রক্ষা বাঁধের স্থায়ী প্রকল্পের কাজ শুরু করেছি। এতে প্রায় ৩.৩৬ কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকা স্থায়ী বাঁধের আওতায় আসবে। যদিও লঞ্চঘাট হতে পুরানবাজারের রনাগোয়াল এলাকায় পূর্বের বরাদ্দে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান বিবেচনায় আমরা কিছু জিও ব্যাগ ভর্তি বালুর বস্তা ফেলে আপাতত কাজ করছি। বর্ষার পরেই মূল কাজ শুরু করা হবে।
তবে অবৈধ ড্রেজার ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসন বরাবরাই সোচ্চার থাকে। যার প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে জেলা প্রশাসক কামরুল ইসলাম বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে চাঁদপুর সদরের হরিণা বালুমহাল, মতলব উত্তরের চর ইলিয়ট বালুমহাল, চর সুগন্ধী বালুমহাল, কালীগঞ্জ দিয়ারা বালুমহাল, কাউয়ারচর বালুমহাল, এখলাছপুর বালুমহাল এবং নাওভাঙ্গা ও জয়রামপুর বালুমহাল বিলুপ্তি ঘোষণা করেছেন। তবে এরপরেও অবৈধ ড্রেজারে বালু উত্তোলন যেনো থেমে নেই।
অবৈধ ড্রেজারের মালিক কারোরি কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে নৌপুলিশের চাঁদপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, আমাদের নৌ পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চল কর্তৃক গত ৩ মাসে বালুমহাল সংক্রান্তে রুজুকৃত মামলার সংখ্যা ২২টি, ড্রেজার আটক ১৫টি, বাল্কহেড আটক ২০টি এবং ৮৭ জন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একরামুল ছিদ্দিক বলেন, গত ৩ মাসে প্রশাসনিকভাবে ১২টি অবৈধ ড্রেজারকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়াও এসব ড্রেজারের সাথে জড়িত ৪৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
অবৈধ ড্রেজার প্রসঙ্গে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, এ জেলায় এখন কারোরি ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করার কোন অনুমতি নেই। কিছুদিন আগে সেলিম খানের মেয়ে সেলিনা বেগমের মেসার্স নিপা এন্টারপ্রাইজের লোকজন চাঁদপুর সদরের চরজগন্নাথপুর, লগীমারা ও থাকচর লগীমারা মৌজায় বালু তুলছিলেন। পরে আমরা অভিযান চালিয়ে বালু তোলার সঙ্গে জড়িত ৫ জনকে আটক করে ১০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছি। এ সময় তাদের কাছ থেকে নগদ ১১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ও ১টি স্পিডবোট জব্দ করা হয়। পরে জব্দকৃত এবং জরিমানার অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হয়। সুতরাং আইনের বাইরে গিয়ে বালু উত্তোলন এবং অবৈধভাবে ড্রেজার নদীতে পাওয়া গেলেই কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।