... বিস্তারিত
চাঁদপুর পুরাণ বাজারের শ্রী শ্রী রামঠাকুর দোল মন্দিরের দোল উৎসবের ইতিকথা
শ্রী শ্রী রামঠাকুর তখন অবিভক্ত ভারতের অন্যতম নদী বন্দর শহর ও বর্তমান বাংলাদেশের জেলা শহর চাঁদপুরে রোহিণীকুমার মজুমদার মহাশয়ের বাসায় রয়েছেন। কথাছিল কলকাতা যাওয়ার, কিন্তু রওনা হওয়ার মুহূর্তে তিনি কলকাতা যাত্রা বাতিল করে 'তারপাশা' অভিমুখে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। শেষ পর্যন্ত শ্রীশ্রীঠাকুর রোহিণীবাবুর অনুরোধে চাঁদপুরেই দোল উৎসবের স্থান ঠিক করলেন।
তখন চাঁদপুরে শ্রীশ্রীঠাকুরের আশ্রিত ছিলেন মাত্র তিনজন। কারও উৎসব সম্বন্ধে কোন ধারনাই ছিল না। যাই হোক দোল উৎসবের বার্তা দিয়ে চিঠি পাঠানো হল কুমিল্লা, ফেণী, ঢাকা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম শহরে।
শ্রী শ্রী ঠাকুর ফর্দ তৈরী করে দিলেন এবং উপেনবাবুকে পৌরহিত্য করার আদেশ দিলেন। শুনে অনভিজ্ঞ উপেনবাবু কেঁদে ফেললেন। নিজেকে খুব অসহায় বোধ করতে লাগলেন।
কিন্তু তিন ভূবনের অধিপতি যেখানে অনুষ্ঠাণের কর্তা এবং স্বয়ং উপস্থিত, যাঁর আদেশে উনি পূজা করবেন, তাঁর আবার ভয় কি ?ঠাকুর একটু হাসিয়া উপেনবাবুকে পূজার নিয়ম বলিয়া দিলেন এবং বলিলেন,"আপনার কোন চিন্তা নাই, যাহা করিতে হয় আমিই করিব।" দুপুরবেলায় ঠাকুরকে দোলায় বসাইয়া উপেনভাই পূজা করিলেন এবং খিচুড়ি, তরকারী, মিষ্টান্ন, দধি ও সন্দেশ দিয়া ভোগ নিবেদন করিলেন। চাঁদপুরের বাহিরের কোন ভক্ত তখনও আসিয়া পৌঁছিতে পারেন নাই।
স্থানীয় ভক্তদের মধ্যে শুধু ডাঃ অন্নদাচরণ সেন ও ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এই উৎসবে যোগদান করিয়াছিলেন। বিকালে ফেণী হইতে প্রমথদা, ঢাকা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা হইতে দশ-বারো জন গুরুভ্রাতা আসিয়া পৌঁছিলেন।
চাঁদপুরের নতুন বাজার ও পুরান বাজারের অনেক ভক্তরাও রাত্রিতে প্রসাদের জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন আবার নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ব্রাহ্মণও আছেন, কিন্তু কেহই ঠাকুরের আশ্রিত নন, তবে প্রত্যেকেই ঠাকুরকে খুব ভক্তি করতেন।
ভোগের জন্য দশ সের ময়দা,সেই অনুপাতে ছোলার ডাল, তরকারী, মিষ্টান্ন ও রসগোল্লার ব্যবস্থা করা হইল। সন্ধ্যার পরে ঠাকুরকে দোলায় বসাইয়া পূজা ও ভোগ-আরতি হইবে বলিয়া সমস্ত উপকরণ উপেন সাহাবাবু ও ধীরেন সোমবাবু সংগ্রহ করিয়াছেন। রোহিনীবাবু নিমন্ত্রিতদের জন্য কয়েকটি কাপ ও প্লেট দোকান হইতে আনিবার জন্য বাহির হইতে যাইবেন, এমন সময় দেখিলেন সদর গেটের নিকট বহু লোকের ভীড় জমিয়াছে, তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ বলিতেছেন, "দেখিতে হইবে রোহিণী-মাষ্টার মানুষকে দোলায় বসাইয়া তুলসীপত্র পায়ে দিয়া কেমন করিয়া পূজা করে।"
কাপ ও প্লেট লইয়া ফিরিয়া আসিয়া রোহিনীবাবু দেখিলেন অনেক লোক তাহার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। উপেনবাবু সময়মত পূজা সমাপন করিয়া আরতি আরম্ভ করিলেন। যে ঘরটিতে পূজা হইতেছে সে ঘরটি ৭০ ফুট লম্বা ও ৩০ ফুট চওড়া। আরতির সময় দ ঘরটিতে তিলার্দ্ধ পরিমান স্থানও নাই। মনে হইল এইসব লোক বোধহয় কৌতুক দেখিতে আসিয়াছেন। আরতির শেষে দেখা গেল ঠাকুরের পায়ে (চরণে)আবির দেবার জন্য খুব ঠেলাঠেলি হইতেছে।
আবির খুব বেশী পরিমাণে না থাকায় দোলা হইতে ঠাকুর তাঁহার পায়ের কাছের আবির দেখাইয়া বলিলেন,
” ঐ আবিরগুলি তুলিয়া দেন”। এই ব্যবস্থায় উপস্থিত প্রায় সকলেই শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীপাদপদ্মে আবির দিতে পারিলেন। ঠাকুর ঘরে চলিয়া গেলেন, এদিকে সবাই প্রসাদ লইবার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
প্রসাদের পরিমাণ সামান্য, প্রায় চারিশত লোক উপস্থিত, এত লোকের প্রসাদের ব্যবস্থা কি হইবে? ভীষণ চিন্তিত ও ভীত হইয়া পড়িল রোহিনীবাবু। তাহার মনের কথা শ্রীশ্রীঠাকুরের নিকট সব জানাইলে তিনি বলিলেন, ” যান, সবাইকে প্রসাদ দেন গিয়া। ” কম্পিত দেহে বাহিরে আসিলে প্রমথদা আমাকে এক স্থানে বসাইয়া রাখিয়া উপেনবাবুকে লইয়া আমার ছোট বাগানে গিয়া অনেক কলার পাতা কাটিয়া আনিলেন। কলাপাতায় করিয়া প্রমথবাবু ও উপেনবাবু প্রসাদ দিতে আরম্ভ করিলেন। রাত্রি বারোটা পর্য্যন্ত প্রসাদ বিতরণ করা হইল, তবুও প্রসাদ শেষ হইল না,সবাই বসিয়া বেশ তৃপ্তি সহকারে প্রসাদ পাইলেন। ঠাকুরের অসীম দয়া, কিভাবে এত লোকের সমাগম ও প্রসাদ বিতরণ হইল বুঝিতে পারেন নাই রোহিনী বাবু।
এভাবে চাঁদপুর শহরের নতুন বাজারে পর পর চার বছর দোল উৎসব অনুষ্ঠিত হবার পর ১৩৩৩ বঙ্গাদ্ধে ঁ জগবন্ধু সাহা মহাশয় নিজ উদ্যোগে পুরান বাজারের ত্রিবেনী সঙ্গমে ( পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল) নিজ বাড়িতে দোল উৎসব আয়োজন করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর ভক্তিমতি বিধবা সহধর্ম্মিনী নিঃসন্তান থাকায় তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ঠাকুরের নামে দান করে দিলে সকল রামাশ্রিত ও অনুরক্ত ভক্তদের দানে বর্তমান স্হানে গড়ে উঠে শ্রী শ্রী রামঠাকুর দোল মন্দির।
দোল মন্দির নির্মানে এবং দোল উৎসবের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রয়াত গুরু ভ্রাতা জগবন্ধু সাহা ও তাঁর স্ত্রী রেনুকা প্রভা সাহা, যাদব সাহা, সুনিল রাহা, অনিল সাহা মহাশয়রা চিরস্মরনীয়।
শ্রী শ্রী সত্যনারায়ণের সেবা মন্দির, ডিঙ্গামানিকের ঠাকুরের বংশধর মোহন্ত মহারাজগন সবসময়ই দোল মন্দিরের প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন এবং বর্তমান পূজ্যপাদ পঞ্চম মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ ধূর্জটি প্রসাদ চক্রবর্তী মহাশয় তরুন ও নিবেদিত রামাশ্রিতদের সমন্বয়ে বর্তমান মন্দিরের প্রভুত উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।
এ মন্দিরে শ্রী শ্রী কৈবল্যধাম, চট্টগ্রামের পূজ্যপাদ চতুর্থ মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ ভবতোষ বন্দোপাধ্যায় ও ডিঙ্গামানিকের পূজ্যপাদ তৃতীয় মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ সুনিল কুমার চক্রবর্তী এবং পূজ্যপাদ পঞ্চম মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ বিমলেন্দু বিকাশ রায়চৌধুরী ও পূজ্যপাদ চতুর্থ মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ কালী প্রসাদ চক্রবর্তী তথা দুই ধামের মহারাজদের একত্রিত উপস্থিতিতে রামাশ্রিতদের মাঝে যে আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল, তা আজও চির স্মরনীয়।
তথ্য সূত্রঃ ‘শ্রী গুরু শ্রীশ্রী রামঠাকুর’
শ্রীরোহিণীকুমার মজুমদার ও রেনুকা প্রভা সাহার সাথে লেখকের আলোচনা।