মনির হোসেন খানঃ বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তির বিশ্ব। নতুন নতুন প্রযুক্তির সংযোজন আর বিয়োজনে ব্যস্ত তাবর তাবর সব দেশ তথা বিশ্ব নন্দিত প্রযুক্তিবিদরা। বলতে গেলে প্রযুক্তির উপরই অনেকাংশে নির্ভর আমাদের বর্তমান এই বিশ্ব।
তাইতো হর হামেশাই শোনা যায় নতুন নতুন সব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কথা। রাশিয়া যদি তৈরী করে মিগ ২৯, তবে আমেরিকা তৈরী করে ফেলে এফ ১৬, ফ্রান্স তৈরী করে ফেলে মিরেজ। প্রযুক্তির এই ধারাবাহিকতায় বাটন মোবাইল হতে, টাচ মোবাইল, নকিয়া হতে আই ফোন। এনালগ হতে ডিজিটাল, সবই আধুনিক প্রযুক্তির খেলা। প্রযুক্তি মানব জীবনকে অনেকটাই সহজ ও সাবলিল করে দিয়েছে। এখন আর ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাড়ীয়ে বাস বা ট্রেনের টিকিট কাঁটতে যেতে হয় না।
মোবাইলের এ্যাপসের মাধ্যমেই টিকিট কাঁটা যায়। এমন হাজারো উদাহরন আছে প্রযুক্তির ব্যাপারে। এই যেমন আগে কৃষকরা গরু দিয়ে হাল চাষ করতো, এখন আধুনিক প্রযুক্তি আসাতে ট্রাক্টর দিয়ে হাল চাষ করছে কৃষকরা। আগে কৃষকরা ক্ষেত হতে ধান কেঁটে এনে বাড়ীতে ধান মাড়াই করতো পুরনো এক প্রাচীন পদ্ধতীতে। কারন সে সময় ধান মাড়াইয়ের আধুনিক কোন প্রযুক্তি ছিলো না।
তখন কৃষকরা বাড়ীর উঠোনের মাঝখানে বাঁশ গেড়ে সেই বাঁশের সাথে গৃহিনীর শাড়ী বেঁধে একটা দেয়াল তৈরী করতো। আর তার মধ্যখানে পুরনো কাঠের পাটাতন বা ড্রাম রাখতো। আর ঐ ড্রাম বা কাঠের পাটাতনের উপর পাঁকা ধানের গোছা গুলোকে সজোড়ে বাড়ি মারতো, এতে করে পাঁকা ধান গুলো গোছা হতে আলাদা হয়ে মাঁটিতে জমা হতো।
এই পদ্ধতিতেই যুগের পর যুগ কৃষক ধান মাড়াই করতো। নব্বইর দশকে বাজারে এলো আধুনিক প্রযুক্তির এক ধান মাড়াই কল। যেটাকে প্যাডেল রাইস মেশিন বা পাঁয়ে চাপা ধান মাড়াই কল বলে। এটা গোলাকৃত্তির একটা মেশিন। কাঠের গোল পাটাতনের উপর ত্রিভূজ আকৃতির অসংখ্য পেরেক গাঁথা থাকে তাতে। নিচে অাছে প্যাডেল বার। কৃষক ঐ প্যাডেলে পাঁয়ের চাপ ফেলতেই তা ঘুরতে থাকে।
আর তখন কৃষক ঐ ঘুর্নিয়মান কাঠের গোল মেশিনটির উপর ধানের গোছা ধরতেই মুহুর্তের মধ্যেই পাঁকা ধান গুলো জমিনে পড়ে জড়ো হতে থাকে। এতে করে কৃষক খুব অল্প সময়ের ভেতর ধান গুলো দ্রুত মাড়াই করতে পারে। এটা নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী আবিস্কার এবং তা প্রযুক্তিরই আশির্বাদ। এখন বৈশাখ মাস। বৈশাশ জৈষ্ঠ এই দুই মাস ইরি ধানের ভরা মৌসুম।
বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের সব কৃষকরাই এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন ক্ষেত হতে ধান কেঁটে এনে ধান হতে চিটা ধান আলাদা করবার পর ধান সিদ্ধ করে রোদে শুকোতে আর ধানের খড় বা নাড়া আলাদা করে রোদে শুকোনোর কাজে। বাংলার প্রায় সব গ্রামেই এই একই দৃশ্যের অবতারনা হচ্ছে এখন। কৃষকরা ব্যস্ত ধান কাঁটতে আর কৃষানিরা ব্যস্ত ধান হতে চিটা ধান আলাদা করতে। ধান হতে চিটা ধান আলাদা করবার এক সুপ্রাচীন পদ্ধতী এখনও আমাদের দেশে প্রচলিত আছে এবং যুগ যুগ ধরে এই পদ্ধতী থাকবে বলেই কৃষানিদের বিশ্বাস।
কৃষকরা যখন ধান কেঁটে এনে বাড়ীর আঙ্গিনায় বা রাস্তার ধারে পাটির উপর রেখে ধান শুকান। ধান গুলো একটু শুকোনোর পরেই কৃষানিরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন পাঁকা ধান হতে চিটা ধান আলাদা করবার বা ধানের ময়লা পরিস্কার করবার কাজে।
এটা কৃষানিরা করে থাকেন তাদের ঘরের ব্যবহার্য কুলোটি দিয়ে। অত্যন্ত নান্দনিক এবং নিপুন ভাবে তারা এই কাজটি করে থাকেন। কৃষানিরা প্রথমে অনেকগুলো ধান কুলোতে তুলে নেন, তারপর সেই ধানে ভরা কুলোটি দুহাত দিয়ে উপরে তুলে নিচের দিকে কাত করে বাতাসের উল্টোদিকে ধরে নাড়তে থাকেন। এতে করে বাতাসের তোড়ে চিটে ধান গুলো একটু দূরে গিয়ে পড়ে আর ভালো ধান গুলো নিচে জমিনে জড়ো হতে থাকে।
এভাবেই এই সুপ্রাচীন পদ্ধতীতেই বাংলার কৃষানিরা যুগের পর যুগ ধরে এই কাজটি করে আসছেন। এই কাজটি করতে তাদের কোন আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োজন হয় না। তাইতো ষাটোর্ধ কৃষানি যোগীতা রানী দাস গর্ব করেই বললেন, প্রযুক্তি আজও আমার হাতের এই কুলোটি কেড়ে নিতে পারেনি এবং পারবেও না। কারন হিসেবে বলেন, আমি আমার দিদিমা, ঠাম্মা, আমার মাসি পিসি সহ সকলকেই দেখেছি তারা এই পদ্ধতীতেই ধানের চিটে আলাদা করেছেন, আমিও তাদের কাছ থেকেই শিখেছি, এবং আমি তা আমার মেয়েদেরকেও শিখিয়েছি।
এই পদ্ধতীটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন আর ফলপ্রসুতো বটেই। উনি জানালেন এই পদ্ধতীটির মৃত্যু নেই। হ্যা নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রযুক্তি এখনও কেড়ে নিতে পারেনি আমার কৃষানি মায়ের হাতের কুলোটি।