পারভেজ মোশাররফঃ “শিক্ষার আলো নাকি ঘরে ঘরে জ্বলবে,আমাদের যে ঘর নাই সে কথা কে বলবে?- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ‘তাবিদ মাহবুদ এবং রাজধানী কামরাঙ্গীরচরের পথশিশু গলি বয় রানা’র যৌথ পরিবেশনায় শিক্ষা নিয়ে করা গানটি সোশ্যাল মিডিয়াসহ সকল শ্রেনী পেশার মানুষের মাঝে বেশ সাড়া ফেলছে। এই লাইনটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অতি গুরুত্বপূর্নও বটে। কারণ দেশের একটা অংশের মানুষ যাদের ঘরই নাই, শিক্ষাটা তাদের স্বপ্নের মতো।
আমাদের দেশে জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশ হচ্ছে শিশু।আর অধিকাংশ শিশুই সামাজিক অবহেলা,পারিবারিক কোলাহল ও দারিদ্রতাসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন। এই ধরণের সমস্যাগ্রস্ত শিশুরই জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার গল্প তৈরী হয় সড়কের পাশে বিভিন্ন স্টেশনে এমনকি বিভিন্ন অবাসযোগ্য স্থানে। এসব কারনেই বিত্তবান এবং সমাজ সচেতনদের ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুর মৌলক নাম শিশু থাকলেও এদের শিশু নামের সাথে যুক্ত হয় পথশিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশু। আর এই শিশুদের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায় পরিবারের নিরক্ষরতা,অসচেতনা আর দারিদ্র্যতার কারনে খুব ছোট বয়সেই এরা কাজ করছে বিভিন্ন কারখানা, ইটভাটায়, হোটেল-রেস্টুরেন্টেসহ নানান পেশায়। এছাড়াও তারা লিপ্ত হয় কিশোর অপরাধে। খুব ছোট্ট বয়সে ঝুঁকে পড়ে সমাজের মারাত্নক ব্যাধি নেশার জগতে।
এমন শিশুদের কথা ভেবেই চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় অসহায়,সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো জ্বালাতে উদ্যোগ নেয় পৌরসভার কয়েকজন তরুন-তরুনী। তারা গঠন করেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুশিক্ষা ও সামাজিক সংগঠন ‘প্রজ্জ্বলন’।প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তারা বেশ-গুরুত্বের সাথে ফরিদগঞ্জ পৌরসভার অর্ধশতাধিক অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা দিচ্ছেন ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাব চত্তরে। এতে করে এক দল শিশুকে নেশা,কিশোর অপরাধ এবং শিশুশ্রম থেকে শিক্ষার আলো দিয়ে রক্ষা করছে ‘প্রজ্জ্বলন’।
প্রজ্জ্বলন’র এমন মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানান সমাজের বিভিন্ন শ্রেনীর-পেশার মানুষ। শিক্ষাদানের পাশাপাশি ক্লাস শেষে শিশুদের নাস্তার ব্যবস্থা করা হয়। প্রজ্জ্বলন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা উপকরনও বহন করে আসছে। আর এমন আর্থিক কর্মকান্ডে নিজেদের মাসিক চাঁদা দিয়ে পরিচালনা করে যাচ্ছেন প্রজ্জ্বলনের সদস্যরা। মাঝে মাঝে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন সমাজের গুনিজনরা। তাছাড়াও শিশু উৎসব,শীতকালে বাচ্চাদের শীতবস্ত্র বিতরন, শীতকালীন খেজুরে রসে বাচ্চাদের নিয়ে রস উৎসব, ঈদ উপহার বিতরণ, ঈদ পূর্ণমিলনীসহ নানান কর্মসূচি পালন করে থাকে সংগঠনটি। এছাড়াও পাঠ্যবইয়ের শিক্ষার পাশাপাশি অন্য সরকারী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিয়ে ‘প্রজ্জ্বলন’র সুবিধাবঞ্চিত শিশুদেরকে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বিগত বছরে সাফল্য অর্জন করে আসছে । প্রজ্জ্বলনের শিক্ষক প্যানেল এবং স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের এমন ভাবেই তৈরী করার চেষ্টা করেন যাতে তারা কোনদিকেই পিছিয়ে না থাকে।
আমার বাড়ি উপজেলার গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নে। ছোটবেলা থেকে আমিও স্বেচ্ছাসেবী কাজ করতে পছন্দ করি। যুক্ত আছি কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনের সাথে। কিন্তু, দীর্ঘদিনের ইচ্ছে সামাজিক কাজের পাশাপাশি পথশিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর। অতপর; ফরিদগঞ্জ পৌরসভাতে ‘প্রজ্জ্বলন’ নামের এই সংগঠনটি সু্বিধাবঞ্চিত বাচ্ছাদের আপন করে নিয়ে এমন মহা কর্মযজ্ঞ দেখে আমিও সংগঠনটির সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। পরিশেষে গত বছরের জানুয়ারীতে প্রজ্জ্বলন’র প্রতিষ্ঠাতা খাদিজা তাসনীম’র সঙ্গে কথা বলে আমিও হয়ে গেলাম প্রজ্জ্বলন পরিবারের একজন। আমার বাসা পৌরসভা থেকে অনেক দূরে হওয়ার কারনে আমি প্রজ্জ্বলনে যুক্ত হওয়ার পর থেকে নিয়মিত বাচ্চাদের ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারি না। তবে, সুযোগ পেলেই চলে আসি প্রজ্জ্বলন’র একদল আন্তরিক স্বেচ্ছাসেবী ও সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের মাঝে। প্রজ্জ্বলনের সাথে কাটানো সময়টা আমার কাছে বেশ ভালো লাগে,খুব আনন্দ লাগে যখন দেখি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রাঙ্গনে প্রজ্জ্বলনের স্বেচ্ছাসেবী এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষার একটা আনন্দঘন পরিবেশ তৈরী হয়।
সর্বপরি, প্রজ্জ্বলন’র সদস্যভুক্ত হওয়ার পর থেকে আমি দেখেছি প্রজ্জ্বলন’র প্রতিষ্ঠাতা খাদিজা তাসনীম আপুসহ সকল স্বেচ্ছাসেবীদের আন্তরিকতা। কিভাবে তারা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আপন করে শিক্ষার আলোর জ্বালাতে শ্রম দিচ্ছেন। সে জন্য আমি তাদের ব্যক্তিগত ভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তাছাড়া যারা বিভিন্ন সময়ে প্রজ্জ্বলনের বাচ্চাদের নাস্তা খরচ,শিক্ষা উপকরন দিয়ে, শীতবস্ত্র দিয়ে সহযোগীতা করেছেন তাদের প্রতি প্রজ্জ্বলনের একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি আশা করি প্রজ্জ্বলনের স্বেচ্ছাসেবীদের এমন আন্তরিকতা আর বিত্তবান এবং সুশীল সমাজের সার্বিক সহযোগিতায় প্রজ্জ্বলন অনেক দূর এগিয়ে যাবে। সকল শ্রেনী পেশার মানুষের সহযোগিতায় প্রজ্জ্বলন হবে দরিদ্র পরিবারের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষার একটা আশ্রয়স্থল। আমি প্রজ্জ্বলনের উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি।প্রজ্জ্বলনের ২য় প্রতিষ্ঠাতাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রজ্জ্বলনের প্রতিষ্ঠাতা, স্বেচ্ছাসেবী,শিক্ষার্থী,উপদেষ্টাসহ সকলের সার্বিক মঙ্গলকামনা এবং সু – স্বাস্থ্য কামনা করছি। ‘শিক্ষা বঞ্চিত না হোক কোন শিশু,সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হোক সকল শিশু’।