মনির হোসেন খানঃ বাবা ইয়াবার ছদ্য একটি নাম। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত মাদকের নাম এই ইয়াবা। এটা মাদক সেবিদের কাছে বাবা নামেই সমোধিক পরিচিত। কেউবা গুটি নামেও ডেঁকে থাকেন। এই গুঁটি বা ইয়াবা কিংবা বাবার নেশায় বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব সমাজ বুদ হয়ে আছেন।
পাশাপাশি এ মাদক সহজলভ্য ও কিছুটা ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকায় বিভিন্ন শ্রেনীপেশার মানুষ সহ সাধারন দিন মজুর হতে রিক্সাওয়ালারাও এ নেশায় চরমভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছেন। অতিতে যারা ফেন্সিডিল বা মদে আসক্ত ছিলেন,তাদের অনেকেই এখন ইয়াবা সেবন করছেন। কারন হলো বর্তমান বাজারে একটি ফেন্সিডিলের দাম দু হাজার টাকা, একটি মদের বোতলের দাম উনিশ শত টাকা।
তাছাড়া এসব মাদক শুধু দামীই না, সহজ লভ্যও নয়। ফলে অধিকাংশ মাদক সেবিই সেসব মাদক হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সহজলভ্য পিংক, বিস্কিট কালার বা ফ্লেভারের দুশো হতে পাঁচশো টাকার ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব সমাজ, সাধারন খেঁটে খাওয়া মানুষ কি পরিমান ইয়াবার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছেন, তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায় সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজধানী তথা মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে গড়ে উঠা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের দিকে তাঁকালেই।
বর্তমানে বাংলাদেশে ছাত্র ও যুব সমাজ এতটাই মাদকাসক্ত যে, তাদেরকে মাদকমুক্ত ও স্বাভাবিক জিবনে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগও ঢাকায় তাদের জন্য একটি আধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র নির্মান করেছেন। আর এসব মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র যেসব মাদক সেবিরা ভর্তি হন তাদের অধিকাংশের বয়স ত্রিশ বছরের নিচে, এবং তারা কলেজ, বিশ্ববাদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র। তার অর্থ হলো বর্তমানে বাংলাদেশের ছাত্র ও যুব শক্তির চরম অবক্ষয়। আর একটা দেশের ছাত্র ও যুব সমাজ যে -সে দেশের চালিকা শক্তি বা মেরুদন্ড তা সরকার তথা সাধারন সকলেই জানেন।
একটি দেশের ছাত্র ও শিক্ষীত যুব সমাজ হলো সে দেশের মেরুদন্ড, মুল চালিকা শক্তি। আর সেই দেশের মেরুদন্ডের যদি এমন পচন দশা হয়, তবে তাতো মহা চিন্তার বিষয়ই হয়। আর সেই চিন্তা হতেই বর্মতান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে দু হাজার আঠারো সালে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব ও পুলিশ বাহিনীর সম্বনয়ে একটি জয়েন্ট ফোর্স গঠন করা হয়েছিল। যাদের নেতৃত্বে সে বছরের জুন মাস হতে সারা বাংলাদেশে মাদকের বিরুদ্ধে কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল। সে সময় বহু চিহ্নিত মাদক কারবারি ও মোস্ট ওয়ানটেড চোরাচালানিদের ক্রস ফায়ার দিয়েছিলো র্যাব।
ঐ সময় সরকারের এলিট ফোর্স র্যাব মাদকের বিরুদ্ধে ছিলো শুন্য সহিষ্ণুতায়। টোটাল জিরো টলারেন্সে। ফল হিসেবে তখন কয়েক মাস সাময়িক বন্ধ ছিলো মাদক চোরা চালান ও কারবার। কিন্তুু কিছুদিন পর আবারও পুরনো স্বরুপে ফিরে আসে মাদক কারবারিরা। আবারও তারা বিস্তৃত করে তাদের ইয়াবা সাম্রাজ্য। অথচ নব্বইর দশকের সময় এ দেশের ছাত্র যুব সমাজের কাছে ফেন্সিডিল ছিলো অমৃত। ফেন্সিডিল ছিলো তাদের প্রিয় মাদক।
সেসময় ছাত্র , যুব সমাজ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী সহ সকলেই ফেন্সিডিলে ফিদা ছিলেন। এখন যেমন পাশের দেশ মিয়ানমার হতে মাদকের গোল্ডেন গেইট খ্যাত টেকনাফ দিয়ে ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকছে, তখন কুমিল্লার ভারতীয় সীমান্ত ছিলো ফেন্সিডিলের গোল্ডেন গেইট। সে সময় দেদারছে ঐ সীমান্ত দিয়ে ফেন্সিডিল ঢুকে সারা দেশে তা পাচার হতো।
তখনকার সময়ে সবচেয়ে আলোচিত মাদক ছিলো এই ফেন্সিডিল। অথচ তখন কিন্তুু ফেন্সিডিল নামক মাদক নির্মুলে ক্রস ফায়ার দেয়ার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু আজ ইয়াবা নির্মুলে ক্রস ফায়ার দিতে হয়। এতেই অনুমেয় যে ইয়াবা বাংলাদেশের জন্য কতটা আগ্রাসী। এটাতো আগ্রাসী হবেই। কারন ইয়াবা নামক এই মাদক মানব শরীরের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকারক। ইয়াবা সেবনে মানুষের স্মরন শক্তি ও মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
যৌনশক্তি নষ্ট হয়ে পুরুষের বন্ধ্যাত্ব দেখা দেয়। মস্তিস্কে রক্তক্ষরন হয়। মানুষের লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। রক্তচাপ বৃদ্ধি হয়ে হার্ট এ্যাটাক হয়। ইয়াবা সেবনকারিদের শরীরে সবচেয়ে বড় প্রভাব যেটা, সেটা হলো ইয়াবা সেবনের পড়ে সেবনকারিদের মাঝে কলহ প্রবনতা, আগ্রাসী ও আক্রমনাত্নক মনোভাব প্রবলভাবে বেড়ে যায়।
যার প্রভাব বর্তমান সমাজে লক্ষনীয়। কিশোর গ্যাং, ধর্ষন, ছিনতাই, হত্যা দিন দিন বেড়ে যাওয়া এই ইয়াবারই প্রভাবের কারনে। যা বর্তমানে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবি ও সমাজ বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলছে। ইয়াবা সেবিদের আরও একটি বিষয় ভাবিয়ে তুলছে আমাদের সকলকে। তা হলো রাষ্ট্রীয় মুদ্রা টাকা। এই ইয়াবা সেবিরা ইয়াবা সেবনের সময় টাকাকে তারা ইয়াবার ধূয়ো টানার পাইপ হিসেবে ব্যপক ভাবে ব্যবহার করছে। ফলে সেবনে ব্যবহার কৃত টাকার একটি কোনা আগুনের আঁচে পুঁড়ে যাচ্ছে। আর এখন বাজারের ছোট খাঁটো সব দোকানেই এমন কোনা পোঁড়া টাকার দেখা মিলছে হর হামেশাই। আর এই পোঁড়া টাকা নিয়ে দোকানী ও ক্রেতার মাঝে বাঁক বিতন্ডা করতে দেখা যাচ্ছে প্রায়ই। যা কখনো কখনো ঝগড়ায় রুপ নিচ্ছে।
এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া অতিব জরুরি। ইয়াবার এই ব্যপক আগ্রাসী থাবা শুধু শহর বন্দরেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা এখন ইউনিয়ন সহ প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌছে গেছে। গ্রামের সহজ সরল মানুষ গুলোও এই মরন নেশা ইয়াবা সেবনে এবং ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। যার প্রমান মেলে স্হানীয় পত্রিকা, মডেল থানার, ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা মামলায়। সহজে বহনযোগ্য আর অল্প পুঁজিতে অধিক মুনাফার কারনে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন বলে জানা যায়।
এই ইয়াবা ব্যবসায় শুধু গ্রামের সাধারন মানুষের নামই আসেনি দেশের সরকারি বেসরকারি না প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ অনেক কর্মকর্তা কর্মচারির নামও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা মিডিয়াতে আসতে দেখা গেছে।
পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন বিভাগের তথা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন শাখার ব্যপক তৎপরতার মাঝেও থেমে নেই ইয়াবা ব্যবসা। শহরের অলিতে গলিতে বিস্তৃত হয়েছে এই ইয়াবা ব্যবসা। নতুন নতুন পদ্ধতিতে চোরাকারবারিরা শহরে ঢুকাচ্ছে এই মাদক। তাদের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পৌছে যাচ্ছে শহর হতে গ্রামে। ইয়াবারএই ব্যপক ধ্বংসাত্নক প্রভাব হতে যুব সমাজকে রুখতে সরকার নানা সময় নানান পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন।
তারই ধারাবাহিকতায় চলতি মাসের আঠারো তারিখ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় মাদকের একটি নতুন আইন করেছেন। এই আইনে মদ্যপান অনেকটাই সহজ হবে বলে ধারনা করছেন মদ্যপায়ীরা। কারন ঐ আইনে বলা হয়েছে একুশ বছরের আগে কোন যুবককে মদ্যপানের পারমিট দেয়া হবে না। আর কোন এলাকায় যদি একশ জন পারমিটধারি মদ্যপায়ী থাকেন, তবে সে এলাকায় একটি বার স্হাপনের অনুমতি দেয়া হবে। সরকারের সকল উদ্যোগই জনগনের হীতের জন্য।
তবে যে উদ্বেগ জনক হারে ইয়াবার ব্যবসা আর ইয়াবাসেবির সংখ্যা বাড়ছে, সে হিসেবে সরকারের মাদক বিরোধী সকল উদ্যোগ কতটা সফল হয় তাই এখন দেখার বিষয়। সবশেষে ভাবনার বিষয় হলো এই যে, আমাদের ছাত্র ও যুব সমাজ তো ধ্বংসের দ্ধার প্রান্তে, সেই সাথে নতুন করে ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় মুদ্রা টাকা। ইয়াবা সেবিরা যে গনহারে টাকা দিয়ে পাইপ বানিয়ে ইয়াবা সেবন করতে গিয়ে টাকাকে আগুনে পোড়াচ্ছে, তাতে ধ্বংস হচ্ছে রাষ্ট্রের মুল্যবান মুদ্রা। সেই হিসেবে রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে উভয় দিক দিয়ে।
একদিকে রাষ্ট্রের মেরুদন্ড ছাত্র যুব সমাজ, আর অন্যদিকে রাষ্ট্রের মুদ্রা। তবে কি আমরা সেই দিনের দিকে ধাবিত হচ্ছি, যেই দিন পৃথীবির মানচিত্রে বাংলাদেশ থাকবে, কিন্তুু আমাদের সোজা হয়ে দাঁড়াবার মতো মেরুদন্ডটা আর থাকবে না। এমনটা হলে তা হবে বাঙালির জন্য দুঃখ ও চরম লজ্জা জনক। আর এই মূহুর্তে তা উদ্বেগজনক তো বলাই যায়।