সুজন দাসঃ সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির বাংলাদেশের কুমিল্লায় শারদীয় দূর্গোৎসবের নানুয়াদীঘির পূজা মন্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে দুষ্কৃতি কর্তৃক প্রতীমা ভাঙ্গচুর ও মন্ডপে মন্ডপে তান্ডপ শুরু করার এক বছর পূর্ণ হয়েছে।আগুনের দাবানলের মতো ওই তান্ডপ আঘাত আনে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের বেশ কয়েকটি পূজা মন্ডপে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মেসেঞ্জারে সংঘটিত হওয়া ওই দুষ্কৃতির দল ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে সাধারণ মুসলিমদেরও বিভ্রান্ত করে মিছিল করে হাজীগঞ্জের বিভিন্ন পূজা মন্ডপে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও ভাঙ্গচুর করতে থাকে। প্রশাসনের বেগ পেতে হওয়া সেই মর্মান্তিক ঘটনার এক বছর হলেও এবারো অনেকটা আতঙ্ক নিয়েই চলছে দূর্গোৎসব।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কুমিল্লায় পূজা মন্ডপে কোরআন রাখার ওই ঘটনা ঘটিয়েছিলো ইকবাল নামের এক মুসলিম যুবক। তবে বিষয়টি বুজবার আগেই কুমিল্লাসহ চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে সাম্প্রদায়িক হামলা নিন্দনীয়। যা নিয়ন্ত্রণে আনতে হাজীগঞ্জের ওই ঘটনায় ১০ মামলার মধ্যে ৬টি মামলার চার্জশীট ইতিমধ্যে প্রদান করা হয়ে গেছে। যার মধ্যে পুলিশ ২টি, ডিবি ২টি, সিআইডি ১টি ও পিবিআই এর ১টি এবং বাকি ৪টি মামলা এখনো তদন্তাধীন রয়েছে এবং আসামীও অজ্ঞাত।
ক্ষতিগ্রস্থ হাজীগঞ্জের শ্রী শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়া পূজার ত্রিনয়ণী সংঘের সহসভাপতি গোপাল সাহা বলেন, গেলো বছরের ১৩ অক্টোবর বিকালে জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার আমাদের পূজা মন্ডপ পরিদর্শন করে মতলব চলে যান। সন্ধ্যায় আমাদের মন্দিরের মূল ফটক হঠাৎ ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তের দল। শত শত ভক্তবৃন্দ মন্ডপে আটকা পড়ে ও ভয় পেতে থাকে। বাহিরে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল ঐ সময়। আমাদের চোখে এখনো সেই আতঙ্কময় হট্টগোলের দৃশ্য ভেসে উঠে।
হাজীগঞ্জ উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি স্বপন কুমার পাল সেই মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, দুষ্কৃতির দল হাজীগঞ্জ বাজার হতে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে মিছিল বের করেছিলো। যেখানে রামগঞ্জের ব্রিজের দক্ষিণ পাড় রান্ধুনীমুড়া থেকে আসা অপর একটি মিছিল এসে হাজীগঞ্জে যোগ দেয়। দু’টি মিছিল এক হয়ে ততক্ষণে শক্তি সঞ্চয় করে দুষ্কৃতি বাহিনীর দল। মিছিলটি পুরো হাজীগঞ্জ পশ্চিম বাজার প্রদক্ষিণ করে সাধারণ মুসলিমদেরও বিভ্রান্ত করে ২/৩ হাজার মুসলিমকে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তারা মন্ডপে মন্ডপে তান্ডপ শুরু করেছিলো।
তিনি বলেন, দুষ্কৃতির দল হাজীগঞ্জের মধ্য বাজারের শ্রী শ্রী রাজা লক্ষ্মী নারয়ণ জিউর আখড়ার ত্রিনয়ণী সংঘের পূজা দেখতে আসা ২/৩ হাজার সনাতনীকেসহ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এর মধ্যে এক স্কুল শিক্ষক মানিক রায় ঘটনা টি দেখে ষ্ট্রোক করে ঘটনা স্থলেই মারা যায়। হট্টগোলের সময় ২০ পুলিশ সদস্য আহত হয় এবং ৪ জন নিহত হয়। পরে গেলো বছর উপজেলার ২৮ টি পূজা মন্ডপের মধ্যে ১২টি পূজা মন্ডপসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের সনাতনীদের বাড়ীঘরে ভাঙ্গচুর ও তান্ডব চলানো হয়। যদিও প্রশাসনের দফায় দফায় আশ্বাসে এবছর ২৯টি পূজা মন্ডপে শারদীয় দূর্গোৎসব চলছে।
চাঁদপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তমাল কুমার ঘোষ বলেন, এবার দূর্গোৎসবের শুরুতেই স্থানীয় সাংসদ মেজর রফিক, ডিসি ও এসপিসহ জনপ্রতিনিধিগণ সবাই মিলে হাজীগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমাবেশ করা হয়েছে। মানুষ এখন ধর্মীয় অপব্যাখ্যা থেকে বেরিয়ে এসে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করে চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার জেলায় ২১৯ টি পূজা মন্ডপে শারদীয় দূর্গোৎসব চলছে। আমরা পূজার স্থান নির্বিগ্ন ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাখতে প্রতিনিয়ত প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে যাচ্ছি।
শারদীয় দূর্গোৎসবে জেলা প্রশাসন আয়োজিত সনাতনধর্মালম্বীদের নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভায় পুলিশ সুপার মিলন মাহমুদ বলেন, আমরা যেকোন মূল্যে উস্কানিদাতা ও ধর্মান্ধতাকে উৎখাত করতে কাজ করে যাচ্ছি। হাজীগঞ্জের পূজা মন্ডপের হামলা ঠেকাতে পুলিশের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে ঘটনাস্থলেই ঐ সময় ৪ দুষ্কৃতিকারী নিহত হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি কেউ যদি এবারো বিনষ্ট করতে আসে। প্রয়োজনে এবার তার চেয়েও ভয়াবহ পদক্ষেপ নিতে পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে।
শারদীয় দূর্গোৎসবকে ঘিরে সতর্ক অবস্থানে জেলা প্রশাসন জানিয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ কামরুল ইসলাম বলেন, আমরা হাজীগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতিসহ জেলাতেও জনপ্রতিনিধি ও সনাতনী বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দসহ একাধিকবার বসেছি। দেশেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে নিতে সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির থেকে রক্ষা করতে আমরা শারদীয় দূর্গোৎসবের প্রতিটি মন্ডপকে মনিটরিংয়ের আওতায় রেখেছি। সেই সাথে যেকোন অপতৎপরতা রোধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।