চয়ন চন্দ্র ঘোষঃ খামার থেকে দেশী গরুর দুধ সংগ্রহ করার পর তা গরম করে এতে সামান্য পরিমাণ চিনি ঢেলে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণে বানানো হচ্ছে সুস্বাদু ক্ষীর। যা লাকড়ি জ্বলানো চুলার আগুনে করায় স্বর্ণ পদকও পেয়েছেন এক নারী। মতলব ছাড়াও এখানকার ক্ষীর বিদেশে রপ্তানি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী এই ক্ষীর ব্যবসাকে তাই এগিয়ে নিতে তৎপর প্রশাসন।
২০ ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার দুপুরে মতলবের মেক্সি স্ট্যান্ড মোড়, কলেজ রোড ও ঘোষ পট্টি ঘুরলে ক্ষীর বানানোর এই কর্মযজ্ঞ সরজমিনে দেখা যায়।
কলাদী গ্রামের গৃহবধু বিউটি রানী ঘোষ। তিনি লাকড়ি জ্বালানো দাউ দাউ করা আগুনের চুলায় কড়াইয়ের মধ্যে দেশী গরুর দুধ নেড়ে গরম করছেন। এরপর দুধ অনেকটা শুকিয়ে আসতে শুরু করলে এতে সামান্য পরিমাণে তিনি চিনি ঢেলে দিচ্ছেন। এরপরই আরও কিছুক্ষণ নাড়ার পর কড়াই নামিয়ে দুধ জাল দিয়ে উৎপন্ন হওয়া ক্ষীর নির্দিষ্ট পাত্রে ঢালছেন। আর এমন কাজ করেই এই গৃহবধু ২০১৮ সালে পেয়েছেন জাতীয় পল্লী উন্নয়ন পদক। স্বামীকে সাথে নিয়ে সাধারণ গৃহবধূদের কাছে মডেল এই ক্ষীর বিক্রেতা বিউটি রানী ঘোষ।
তিনি বলেন, আমি অনেকটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই ক্ষীর বানানোর কাজটা শুরু করি। এখন দিনে ৪/৫ মণ দুধের ক্ষীর তৈরি করছি। আমার সফলতা দেখে অন্যান্য গৃহবধূরাও এখন ক্ষীর তৈরি করে বিক্রিতে আগ্রহী হচ্ছে।
বিউটি রানীর স্বামী উৎপল চন্দ্র ঘোষ বলেন, আমি অন্য পেশায় থাকলেও স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ক্ষীর বিক্রির জন্য দোকান দিয়েছি। খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতাদের থেকে অনেক সাড়া পাচ্ছি। সৎভাবে বেঁচে থাকার পথ হিসেবে এখন এই পেশাতেই টিকে আছি।
এদিকে বিউটি রানী ঘোষ মাটির চুলায় দুধ জ্বাল দিয়ে ক্ষীর বানালেও মতলব দক্ষিণের অন্যান্য ক্ষীর ব্যবসায়ীগণ নিজস্ব ক্ষীর তৈরির কারখানায় কারিগরের মাধ্যমে করছেন ক্ষীর তৈরি। কেউ কেউ বাপ দাদার দেখানো পেশা হিসেবে জড়িত হয়ে এখন ক্ষীর ব্যবসাকে নিয়ে গেছেন সাফল্যের অনন্য উচ্চতায়। এক একটি দোকান হতে গড়ে ৩০ টি করে ক্ষীরের খোড়া বিক্রি করলেও মাসে তারা আয় করছেন প্রায় লাখ টাকা। এমনকি এখানকার ক্ষীর অনলাইনে অর্ডার হয়ে দেশ পেরিয়ে বিদেশে গিয়ে অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রাও।
মতলব দক্ষিণের প্রাণী সম্পদ কার্যালয়ের তথ্য মতে, এখানে ৩টি রেজিষ্টার ডেইরি খামার ও নন রেজিষ্টার ২৮৯টি ডেইরি খামারে ৪৫০ থেকে ৫০০ টি খামারী দুধ উৎপাদনের কাজে জড়িত। যেখানে মোট ৪৬ হাজার ২২৫ টি গরুর মধ্যে শুধুমাত্র দেশি জাতের গরু রয়েছে ৩০ হাজার ৯৯৪ টি। আর এগুলোর মধ্যে দুধের চাহিদা মিটাচ্ছে ৬ হাজার ২৫৪টি দেশি গাভী গরু। যেখান হতে বছরে ০.২৩ মে.টন অর্থাৎ ২কোটি ৩০ লক্ষ লিটার দুধ পাওয়া যাচ্ছে। যা মাসে ০.০২৭ মে. টন অর্থাৎ ২ লক্ষ ৭০ হাজার লিটার।
জানা যায়, ক্ষীরকে কেন্দ্র করে মতলবের ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেব মন্দির সংলগ্ন এলাকা, নারায় পুর বাজার, সাহেব বাজার, গাজীপুর বাজার, দগরপুর বাজার ও নায়ের গাঁও বাজারে সারি সারিভাবে বসে দুধ বেচাকেনার প্রচলন শুরু হয়েছে। যেখানে ঢাকির গাও এবং নারায়নপুর বাজারের খামারিরাও দুধ নিয়ে আসেন।
আদি গান্ধি ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডারের পরিচালক সজল ঘোষ বলেন, চাহিদা মেটাতে আমাদের মতো ক্ষীরের দোকানীদের নিজেদেরকেই গরু খামার পরিচালনা করতে হয় কিংবা অন্য বড় খামারিদের সাথে চুক্তিতে গিয়ে দুধ সংগ্রহ করতে হয়। এক কেজি দুধের দাম অনুসারে ক্ষীর ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা দামে বিক্রি হয়। এক কেজি ক্ষীর বানাতে ৪ কেজি দুধ ও অল্প পরিমাণে চিনি লাগে। এই মতলবে ক্ষীরের পাশাপাশি মিষ্টি, রসমলাই, দধিসহ দুধজাত অনেক খাবারই বিক্রি হয়।
মতলব দক্ষিণ যুব ঐক্য পরিষদ নেতা চন্দন বিশ্বাস বলেন, আমাদের এই মতলবে আদি গান্ধি ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার, ঘোষ কেবিন সুইটস, ভাই ভাই সুইটস এন্ড মিষ্টান্ন ভান্ডার, মধুবন মিষ্টান্ন ভান্ডার, আনন্দ ক্ষীর হাউজ, বৈশাখী সুইটসসহ অন্যান্য দোকানগুলোতে সকাল হতে রাত পর্যন্ত ক্ষীর বেচাকেনা হয়। তাই তাদের নির্বিগ্নে বেচাকেনাসহ সার্বিক পরিস্থিতে পাশে রয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ থানার ওসি রিপন বালা বলেন, এই মতলবের ক্ষীর সারাদেশেই বিখ্যাত। এখানে যারা ক্ষীর ব্যবসা করছেন আইন-শৃঙ্খলাজনিত যেকোন প্রয়োজনেই তাদের পাশে সবসময় রয়েছে পুলিশ।
এ বিষয়ে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতিমা সুলতানা বলেন, স্বাস্থ্য সম্মতভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন উপায়ে ক্ষীর বানাতে প্রশিক্ষণসহ আরও স্বর্ণপদক জয়ী বিউটি রানী ঘোষ তৈরি করতে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। মতলবের সুস্বাদু এই ক্ষীরের সুখ্যাতি সারাদেশে ছড়াতে সবসময়ই ক্ষীর ব্যবসায়ীদের পাশে থাকবে উপজেলা প্রশাসন।