খান জাহান আলী কালু পাটওয়ারীঃ দুজনেই ধর্মীয় পন্ডিত, আলেম, শিক্ষক। এই সব নিয়ে বলার কিছুই নাই। একজন মানুষ হিসেবে সে যেকোন লাইনে পড়ালেখা করে বিশেষজ্ঞ হবার অধিকার দেশের আইনেই আছে।
প্রশ্ন হলোঃ দেশের এই আইন কোথা থেকে এলো? কিভাবে পেলাম? ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে এই আইন তৈরি হয়েছে। এটা কিন্তু কোন ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় নাই। অর্জিত হয়েছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদী যুদ্ধের মাধ্যমেই।
আসল আলাপটা এখানেই। এই বাংলাদেশ অর্জনে মাওলানা আজিজুল হকের ভূমিকা ছিল উল্টো, মানে বিরোধী। তিনি বাংলাদেশ জন্মের বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম’ নামক সংগঠনের নেতা। নেতা হিসেবে তিনি বিরোধীতা করেছেন, যা ১৯৯৭ সালের সালের ৫ই সেপ্টেম্বর “বিচিত্রায়” প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলে গেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সাংবাদিক গোলাম মোর্তুজা। যিনি এখন ডেইলি স্টারের বাংলা বিভাগের প্রধান।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে বিভিন্ন এলাকার স্বাধীনতা বিরোধী মওলানারা নিজ এলাকা ছেড়ে দূরে চলে গিয়েছিলেন, পরিচয় ও কৃতকর্ম গোপন করতে। সম্ভবত একই কারণে একাত্তরের পরে আজিজুল হক বরিশাল চলে গিয়েছিলেন। যেমন কিশোরগঞ্জের একজন মওলানা চলে গিয়েছিলেন ময়মনসিংহে।
একদা তিনি ছিলেন হাফেজ্জী হুজুরের অনুসারী বা মুখপাত্র। মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর নামের ওই লোক নিজেও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ঘোরতর বিরোধী এবং বাংলাদেশ বিরোধী।কেননা ”জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ”, ”তাহরীকে খেলাফত বাংলাদেশ” ইত্যাদি রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি দারুনভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন।
এই আজিজুল হকের পুত্রই বর্তমান মামুনুল হক।
মামুনুল হক যখন তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার ছাত্র, ১৯৯৪ সালে একজন শিশু শিক্ষার্থীর সাথে বলাৎকারের অভিযোগ ওঠে তার নামে। নায়েবে মুহতামীম (ভাইস প্রিন্সিপাল) মুফতি মানসুরুল হক তদন্ত করে সত্যতা পেয়ে মাদ্রাসা থেকে তাকে বহিস্কার করেন। এই মাদ্রাসাটি ১৯৮৮ সালে তাঁর পিতা মাওলানা আজিজুল হক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনিই ছিলেন মুহতামীম (প্রিন্সিপাল)।
শিক্ষকতা করতে গিয়েও একই ঘটনা ঘটে ১৯৯৯ সালে। সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত জামিয়া নিজামিয়া বেতুয়া মাদ্রাসায় নুরুল আলম নামক এক ছাত্রের সঙ্গে বলাৎকারের অভিযোগ ওঠে। এটিও তদন্তে সত্য প্রমাণিত হয়। যথারীতি মাদ্রাসার মুহতামীম মাওলানা মাহমুদুল আলম তাঁকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেন। মিডিয়ায় এসব এসেছে। তাঁর ব্যক্তি জীবনের ঘটনা সব প্রকাশ হওয়ার পরেও তিনি এভাবে সাধু সেজেছিলেন!
জান্নাত আরা ঝর্ণা ইস্যু নিয়ে নতুন করে কিছু বলছি না। সকলেই অবগত ও প্রমাণিত।
মামুনুল হকের রাজনৈতিক অবস্থান একটি বক্তব্যেই স্পষ্ট হয়। তিনি মনে করেন, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি বলে মত দেন।
এখানেই তাঁর সঙ্গে আমাদের দ্বিমত, এখান থেকেই বৈপরীত্য স্পষ্ট।
তাঁর পিতা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, পিতার গুরু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে; তাঁর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশে। বংশ পরম্পরায় পারিবারিকভাবেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী।
তাঁদের এই অবস্থানের ধারাবাহিকতায় হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালের ৬ মার্চ তাঁরা ১৩ দফা ঘোষণা করেছিলো। বেশ কয়টি রাজনৈতিক দল সমর্থনও দিয়েছিল। বিএনপি-ও সমর্থন করেছিল। এক্ষেত্রে কথা স্পষ্ট, তাঁদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার সুযোগ আওয়ামী লীগ সরকারের নাই, একদমই নাই। তাঁদের ১৩ দফা বাস্তবায়ন করতে হলে তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক, ইশতেহার নিয়ে জনগণের কাছে যাক, মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসালে ১৩ দফা কেন ২৬ দফা বাস্তবায়ন করুক, জিয়াউর রহমানের ১৯ দফাও বাস্তবায়ন করুক। কিন্তু প্রেশার গ্রুপ হয়ে রাজনীতি করে ফায়দা নেবে, দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে নিয়ে যাবে, তা হবে না। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা সত্তরের নির্বাচনে হেরে গিয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল, ভুলে গেলে চলবে?
আমাদের পূর্বপুরুষেরা, অগ্রজেরা এই দেশটা অর্জন করতে অনেক রক্ত দিয়েছেন, অনেক নির্যাতন সয়েছেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের রাজনীতির পরম্পরা দেখুন, একদিনে কিংবা দাবী জানিয়ে এমনি এমনি দেশটা স্বাধীন হয় নাই। বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬’শ ৮২ দিন/ প্রায় ১৩ বছর জেল খেটেছেন। হাওয়া থেকে এসে নেতৃত্ব দেন নাই।
আরেকটা জরুরি কথা হলো, মামুনুল হক গংয়ের এই অবস্থানের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই।
যেমন ১৯৭১ সালে ছিল না। তাঁর পিতা ও অন্যান্যরা সরাসরিই ইসলাম ধর্মকে হাজির করেছিলো, কিন্তু মানুষ গ্রহণ করে নাই। কারণ তারা ছিল ধর্ম ব্যবসায়ী। এখন যেমন মামুনুল গং হলো ধর্ম ব্যবসায়ী।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে ধর্মনবিরপেক্ষতা-ই থাকবে। এটাই শেষ কথা।
আর যদি এই বাংলাদেশকে তাঁদের মতো ধর্মীয় রাষ্ট্র বানাতে চায়, তাহলে আরেকটি যুদ্ধ করতে হবে এবং সেই যুদ্ধে বিজয়ী হলে তাঁদের ইচ্ছে মতো আইন বানাবে। এমনকি আমাদের বিচারও করবে। তাতে আপত্তির কী আছে!
কিন্তু এখন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার পরম্পরায় তাঁদের যা খুশি বলার, করার এবং চাপ দেবার সুযোগ নাই। অধিকারও নাই। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসাবে আমার এই আকুতি। জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক
খান জাহান আলী কালু পাটওয়ারী,
ইউপি চেয়ারম্যান ও সভাপতি, ১২নং চান্দ্রা ইউনিয়ন পরিষদ ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।
