মোঃ হোসেন গাজীঃ মেঘনার কোল ঘেঁষে নদী বিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাইমচর। নদীর সাথে এ অঞ্চলের মানুষের গভীর মিতালী। নদী ভাঙনের ফলে মেঘনা নদী এ এলাকার মানুষের দুঃখ দুর্দশার প্রধান কারণ ছিলো। কিন্তু বর্তমানে নদী শাসনের ফলে মেঘনা নদী আশীর্বাদে রুপ নিয়েছে। ভাঙনের ফলে চাঁদপুরের উপজেলাগুলোর মধ্যে স্থলভাগ বিবেচনায় আয়তনের দিকে থেকে সবচেয়ে ছোট উপজেলা হাইমচর। উপজেলার অধিকাংশ মানুষ মাছ ধরে ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
তবে, এ উপজেলার অর্থকারী ফসলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পান ও সুপারি। বারো মাসই কম-বেশি উৎপাদিত হয় এ দু’টি ফসল। বিশেষ করে পান বছরের সবসময় পাওয়া যায়।
এ অঞ্চলে প্রায় ৫/৬ যুগ আগে থেকেই পান চাষের প্রচলন শুরু হয়।
গত কয়েকদিন উপজেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে জানা যায়, হাইমচরে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নে পান-সুপারি অন্যতম উপকরণ। যেকোনো অনুষ্ঠানে পান-সুপারি থাকবেই। একসময় এ জেলার বাড়ির আঙিনায় নিজেদের প্রয়োজনে পান-সুপারি লাগাতেন। কিন্তু বর্তমানে এটি বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ায় এ চাষে ঝুঁকছেন সবাই।
তবে, জলাবদ্ধতাই পান চাষে ক্ষতির মূল কারণ। শীত মৌসুমেও পানে পচন ধরে বলে জানালেন কৃষকরা। পান চাষ করে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা সন্তোষজনক উন্নতি হয়েছে।
সম্প্রতি হাইমচর উপজেলার পান ও সুপারি চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ উপজেলার গন্ডামারা, দক্ষিণ আলগী, কৃষ্ণপুর ও বাজাপ্তি, মহজমপুর, আলগী বাজার, ঢেলের বাজার, জনতা বাজার, রায়ের বাজার গ্রামে পান চাষ হয় সবচেয়ে বেশি। যারা পান চাষ করেন তাদের মধ্যেই অনেকেরই বানিজ্যিকভাবে সুপারি বাগান রয়েছে। আবার কেউ কেউ শখের বশে বাড়িতে সুপারির বাগান করেছেন। পুরো উপজেলা জুড়েই চোখে পরে পানের বরজ আর সুপারির বাগান। এসব দেখে সহজেই অনুমান করা যায় অর্থকরী ফসল দু’টি এই এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছে।
দক্ষিণ আলগী ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের পানচাষী সরদার নূরে আলম জিকু জানান, প্রায় ১ যুগ ধরে তিনি পানের চাষ করছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া পান চাষ খুবই লাভজনক। পানের বরজগুলো রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মালিক শ্রমিক কাজ করেন। পান চাষ করে তার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট সন্তোষজনক।
পশ্চিমচর কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রব খান জানান, বাজারে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো। কিন্তু দোকান আগুনে পুড়ে সে স্বর্বশান্ত হয়ে যায়। তখন সামান্য লোন নিয়ে পান চাষ শুরু করেন। বর্তমানে আব্দুর রব খানের সুদিন ফিরেছে। তিনি বলেন, এই পর্যন্ত তার পানের বরজে কখনোই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি। তবে, শীতকালে পানে কিছুটা পচন দেখা দেয়। তখন অনেক পান নষ্ট হয়ে যায়।
তিনি আরো জানান, পানের দাম এখন কিছুটা কম, প্রতি বিড়া পান ২০ থেকে ৩০ টাকা। আবার বড় সাইজের পান ৫০-৬০ টাকা।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি বাড়ির পাশেই রয়েছে ছোট, বড় অসংখ্য সুপারির বাগান। সুপারির মৌসুমে খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে সুপারি কিনেন ব্যবসায়ীরা।
হাইমচর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ‘উপজেলায় স্থানীয়ভাবে মহানলী, চালতা কোঠা, নল ডোগ, সাচিপান বেশি চাষ হয়। এর মধ্যে সাচি পানের চাষই সবচেয়ে বেশি। আর সুপারির কোনো জাত নেই স্থানীয়ভাবে যে সুপারি রয়েছে সেগুলোই পাওয়া যায়। সুপারি চাষের জন্য কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।’
হাইমচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার জানান, এই উপজেলার প্রায় ২১৭ হেক্টর জমিতে পান এবং প্রায় ৩১০ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হয়। এই পান-সুপারি চাষের সঙ্গে প্রায় সহস্রাধিক কৃষক জড়িত রয়েছেন। এ দু’ফসল থেকে বছরে একজন কৃষক কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা আয় করেন।’
তিনি আরো জানান, হাইমচর উপজেলার কৃষকরা পান ও সুপারি চাষ করেই পরিবারের খরচ জোগান। হাইমচরের পান ও সুপারি উপজেলা চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলায়,উপজেলায় বিক্রি হয়। অনুকূল পরিবেশ থাকায় নদীকূলবর্তী এই হাইমচর উপজেলায় পান ও সুপারি ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।