চাঁদপুরে কাঠমিস্ত্রিপাড়াগুলো এখন নৌকা বানানোর শব্দে মুখরিত সুমন আহমেদঃ চাঁদপুরের কাঠ মিস্ত্রি পাড়াগুলো এখন যেন নৌকা বানানোর শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে। ছোট, বড় ও মাঝারী আকারের নানা দামের কাঠের নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। বর্ষার আগমন উপলক্ষে কাঠমিস্ত্রিদের পাশাপাশি চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষও নৌকা তৈরি, ক্রয় ও মেরামত এবং নৌকার লগি-বৈঠা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।২২শে জুন মঙ্গলবার সরজমিনে চাঁদপুরের মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ ও হাইমচর ঘুরে দেখা যায়, কাঠমিস্ত্রিদের দম ফেলার সময় নেই এখনে। বিশেষ করে মতলব উত্তরে ছেংগারচর পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়নে প্রায় সাড়ে ৩’শ গ্রাম রয়েছে। এখানে মেঘনা-পদ্মা ও ধনাগোদা নদীর তীর ও চরাঞ্চলে বহু লোকের বসবাস। আশ পাশের খাল ও বিলে বর্ষার পানি বেড়ে গেছে। বিভিন্ন কায়দায় জেলেদের মাছধরা শুরু হয়ে গেছে। আর এজন্যই চরাঞ্চলের অন্যতম হাতিয়ার নৌকার কেনাবেচার হিড়িক পড়েছে।সরজমিনে মতলব উত্তরের বিশাল চরাঞ্চলসহ পাশের মুন্সিগঞ্জের সটাকী, গালিমখাঁ বাংলাবাজার, কালিপুর বাজার থেকেও নৌকা কিনতে লোকজন কাঠমিস্ত্রি পাড়াগুলোতে ভীড় জমাচ্ছেন।ফয়সাল নামের এক নৌকা ক্রেতা জানান, চরাঞ্চলের জনপদের এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। তবে বর্ষায় অধিকাংশ মানুষের বাহন এখনো নৌকা। কেননা হাটবাজার করা, আত্মীয় বাড়ি যাওয়া, এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাওয়াতে এই নৌকাই ভরসা।সটাকী বাজারের রমাকান্ত সূত্রধর ও হরিপদ সূত্রধর বলেন, দাদার আমল থেকেই বর্ষা আসলে নৌকায় লোহা মারার ধামধুম শব্দ আর আলকাতরার মজার গন্ধ মিস্ত্রি পাড়াগুলোতে পাওয়া যায়। মতলব উত্তরের সটাকী বাজারে বসে নৌকার বড়হাট। ক্রেতা-বিক্রেতাদের নৌকার দরদামের হাঁকাহাঁকিতে এখন মুখরিত বাজার। এ বাজারে বর্ষা মৌসুমে চলাচলের জন্য ১০-১২ হাতের এক একটি ডিঙ্গি নৌকা কাঠের প্রকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ১২-১৩ হাজার টাকায়। মহাবীর সূত্রধর বলেন, মৎস্যজীবী বা গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য বাজারে আসছে শিমুল কাঠের তৈরি কম দামের নৌকা। এলাকার দরিদ্র মানুষ শিমুল কাঠের তৈরিকৃত নৌকা বেশি কিনছেন। কেননা বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া চলেই না আমাদের। নৌকায় পরিষদে যাই, হাটে যাই।সুতরাং আমাদের জীবনের অন্যতম অধ্যায় নৌকা।গালিমখার বাংলা বাজারের নৌকা বিক্রেতা সুবোল ও তারপদ সূত্রধর বলেন, প্রেত্যেক সপ্তাহে ১২-১৩ টা নৌকা আমরা বিক্রি করি। ১০-১২ হাত একটা নৌকে বানাতে খরচা হয় ১০-১৫ হাজার টাকা। তারা আরো জানান, মালামাল পরিবহনের বড় নৌকা বানাতে লাখ টাক খরচ হয়।চরকাশিম গ্রামের বজলুর রশিদ দেওয়ান সহ মিস্ত্রিরা বলছেন, লোহার (তার কাটা) দাম বেড়ে গেছে বলে নৌকা তৈরির খরচও বেড়ে গেছে। আগের থেকে লাভ কমে গেছে। সপ্তাহের রবি-বুধবার সটাকি বাজারে অর্ধশতাধিক নৌকা বিক্রি হচ্ছে।সটাকি বাজারের নৌকা বিক্রেতা অনীল চন্দ্র জানান, সব ধরনের কাঠেই নৌকা তৈরি করা যায়। তবে সাধারণ মানুষের কাছে অল্প খরচে শিমুল কাঠের তৈরি নৌকার চাহিদা বেশি। এ ছাড়া ভালো কাঠ দিয়ে তৈরি ১০-১২ হাত একটি নৌকা তৈরিতে খরচ পড়ে প্রায় ৭-৮ হাজার টাকা। বড় নৌকা তৈরি করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকাও খরচ পড়ে। এসব বড় নৌকা দিয়ে বড় ব্যবসায়ী বা সওদাগররা ধান-পাটসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের মালপত্র আনা-নেওয়া করেন। বাংলা বাজারের নৌকা তৈরির মিস্ত্রি বাবলু সূত্রধর বলেন, আমরা কারিগররা ছোট-বড় আকার অনুযায়ী এক একটি নৌকা তৈরি করতে ৩ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত মজুরি নিয়ে থাকি। তবে দিন দিন কাঠসহ নৌকা তৈরির সরঞ্জামের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো লাভ হয় না। তবুও বাপ-দাদার পেশাকে এখনও ধরে রেখেছি।সটাকী বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান মোল্লা বলেন, এ বাজারের অন্তত ১৫টি দোকানে বর্সা মৌসুমে কাঠের নৌকা তৈরি করে বিক্রি করে থাকে। এ কাঠের জোগান দিতে বাজারে ৫টি স’মিল কাজ করছে।চাঁদপুর জেলা মৎসজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক মানিক দেওয়ান বলেন, মাছধরার জন্য ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা মৎস্যজীবীদের জীবীকার একমাত্র বাহন। তাই চরাঞ্চলের জনপদে নৌকা তৈরি ও বেচাকেনা চলছে। মতলব উত্তরের সটাকী, গালিমখাঁ বাংলাবাজার, কালিপুর বাজার ও মতলব দক্ষিণের বরদিয়া, মুন্সিরহাটে নৌকার হাট বসেছে।এ বিষয়ে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী অফিসার গাজী শরিফুল হাসান বলেন, নৌকা তৈরি ও বিক্রির সাথে জড়িত কারিগরসহ অন্যদের সরকারি পৃষ্টপোষকতা বা সহায়তা করা যায় কিনা? তা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানাবো।